রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

বাংলাদেশের সংকট নিরসনে

এমাজউদ্দীন আহমদ


প্রফেসর স্কিডমোর (Max J. Skidmore) এবং প্রফেসর ট্রিপ (Marshall Carter Tripp) যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের বিশ্লেষণে লিখেছেন : বিশ্বের অধিকাংশ জনপদে জনগণ বসবাস করেন বিভিন্ন রূপ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায়। এসব জনপদে জনগণ অধিকার (Rights) লাভ করেন সরকারের কাছ থেকে অনেকটা দাক্ষিণ্য বা অনুগ্রহের মতো। 'আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় কিন্তু ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে স্থিত রয়েছে জনগণের মধ্যে। জনগণই এ ক্ষমতা সরকারের হাতে তুলে দেয় এবং সরকার সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে তা প্রয়োগ করে।' [In the American system the power ultimately is lodged in the people, and they grant power to the government which exercise it within strict limitation] - এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সুষম বিকাশ ঘটেছে। কখনো কোনো সময় নাগরিকদের অধিকারে সরকার হস্তক্ষেপে সাহসী হয় না। অনেকটা আমেরিকার নাগরিকের মতো আমরাও বলতে পারি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনগ্রসর থেকেও অন্তত তত্ত্বগত দিক থেকে বাংলাদেশেও 'প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ' (All powers in the Republic belong to the people)। প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক নন জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, নন নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারও। আমেরিকার নাগরিক এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকারের পার্থক্য শুধু একটি এবং তা হলো. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যা বাস্তব, বাংলাদেশে তা শুধু কেতাবী, সংবিধানে লিখিত সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্যটি। তাই দেখি যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বাস্তবে কার্যকর, বাংলাদেশে এখনো তা জনগণের আকাঙ্ক্ষায়।

যে গণতন্ত্র বাংলাদেশে এখনো জনগণের আকাঙ্ক্ষায়, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়াই তো নির্বাচিত সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ। এ দেশের জনগণকে যদি তারা সত্যি সত্যিই ক্ষমতার মালিক মনে করেন, তবে এর কি কোনো বিকল্প আছে? গণতন্ত্র বা স্বশাসন কিন্তু সুশাসন ছাড়া কখনো বাস্তবায়িত হয় না। তাছাড়া গণতন্ত্র শুধু সুনির্দিষ্ট সময় কালের ব্যাপার নয়, ভবিষ্যতেও যেন তা জনগণের জন্য অর্থপূর্ণ হয়ে অব্যাহত থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে।

আমার ধারণা, আমাদের রাজনীতিকরা দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, তার যোগ্য সন্তান তারা। বাংলাদেশ কিন্তু আজ সংঘাত, হিংসা-প্রতিহিংসার আগুনে ঝলসে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছে বাসের অযোগ্য এক জনপদ। শান্তিপূর্ণ জীবনের অযোগ্য। এ জন্য দায়ী আমরাই। এটা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্দৈব। কারও প্রতি কোনো অভিযোগ না রেখেই বলব। এ জনপদকে আবারও আমরা পরিণত করতে পারি স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য এবং শান্তি ও সুখের স্বপ্নরাজ্যে। এ জন্য প্রয়োজন শুধু রাজনীতিকদের কল্যাণকামী মন। হিংসা-প্রতিহিংসা-জেদশূন্য আকাশের মতো উদার মন।

এখন দেশে যা ঘটে চলেছে তার মূলে রয়েছে প্রধানত ২০১১ সালের ১০ মে কিছু পর্যবেক্ষণসহ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা। রায়ের পূর্ণ কপি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এবং জনকল্যাণের বিবেচনায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন এ ব্যবস্থার মাধ্যমে হতে পারে। দেশের রাজনীতিকরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ২০১১ সালে সমাপ্ত জাতীয় সংসদে কিন্তু রাজনীতিকরা এদিকে না তাকিয়ে সমগ্র ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন পঞ্চদশ সংশোধনীতে। এ বিষয়ে আলোচনার ঝড় চলছে জোরেশোরে। বলতে দ্বিধা নেই, দেশে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণার বিষয়টি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে চিহ্নিত করেছে। কেউ কেউ আপিল বিভাগের রায়কে স্ববিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ক্ষমতাসীন জোট খুশি হয়েছে এই ভেবে যে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা সাধারণ নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হবে না। প্রয়োজনবোধে ক্ষমতাসীন থেকেই নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে এবং একদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা সম্ভব হবে। প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে তা তখন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। আপিল বিভাগের সব বিচারপতি এ বিষয়ে একমত হননি। সংখ্যাধিক্যের জোরে এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে এ রায় বাংলাদেশে সৃষ্টি করেছে এমন সমস্যা যাতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

আমার মতো সাধারণ একজন নাগরিক জাতীয় জীবনের এ সংকটকালে ছোট্ট একটা সুপারিশ রাখতে চাই। জানি, এটিও বিতর্ক সৃষ্টি করবে। তারপরও বলতে চাই, অনির্বাচিত ব্যক্তির দ্বারা নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি গণতান্ত্রিক সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা নির্বাচনী পরিষদ অথবা কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতে পারে যারা নবম সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের সমন্বয়ে। দেশে যে দুটি রাজনৈতিক জোট বিদ্যমান তাদের মধ্যে যে পারস্পরিক বিদ্বেষ, অনাস্থা এবং অবিশ্বাস বর্তমান সেই প্রেক্ষাপটে নবম সংসদের কার্যকাল সমাপ্ত হলে দুই বড় দল থেকে সমানসংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে আগামী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এ সরকার বা সংস্থা গঠিত হতে পারে। এ সংস্থা তাদের কার্যক্রমের জন্য দায়ী থাকবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। সমানসংখ্যক সদস্যের কথা বলেছি তার কারণ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দুই জোটের মধ্যে জনসমর্থনের যে বৈষম্য ছিল এখন তা নেই। ১৮ দলীয় জোটের সমর্থকের সংখ্যা বর্তমানে হয়তো বা একটু বেশি। তাছাড়া ওই নব্বই দিনের কার্যকালে ওই সংস্থার কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ বা পরিকল্পনা গ্রহণেরও কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। তাদের কাজ হবে শুধু একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তাই সেই সংস্থাকে হতে হবে নিরপেক্ষতার প্রতীক (A symbol of neutrality) নিরপেক্ষ নির্বাচনই একমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নির্বাচন অনুষ্ঠান যথেষ্ট নয়। এ নির্বাচনকে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

তখন যেহেতু সংসদ কার্যকর থাকবে না, তাই ওই সংস্থায় সংসদের নেতা এবং বিরোধী দলের নেতার উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু প্রাজ্ঞ, ধীরস্থির চিন্তার অগ্রগামী সদস্যদের। তাদের সমন্বয়ে এ সংস্থা রচিত হতে পারে। এ সংস্থার সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে গৃহীত হলে তা নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক আইনে পরিণত হতে পারে। সংস্থার সদস্য সংখ্যায় পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু দুই এর ভারসাম্য বজায় রেখে এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সাধারণ নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থা নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ না হলে আঠার দলের নেতৃবৃন্দ আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, এই নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না। এমন নির্বাচন হতেও দেবে না। তারপরও যদি ক্ষমতাসীন দল অগ্রসর হয় এবং একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তাহলে সেই নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে তাদের গলার কাঁটা। বিজয়মাল্য হয়ে উঠবে তখন কণ্টকপূর্ণ ক্যাকটাসের মালা।

সমগ্র বিষয়টি সম্পন্ন হতে পারে দুই বৃহৎ দলের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে। তবে সংলাপের প্রাথমিক পর্যায়ে মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের ভূমিকা গ্রহণই বাঞ্ছনীয়। কিছু দূর অগ্রসর হলে অথবা কোনো কোনো বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলে উভয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে তা উপস্থাপিত হলে ভালো হয়। সংলাপকে ফলপ্রসূ করার কয়েকটি পূর্বশর্ত রয়েছে। এক. উভয় পক্ষের মধ্যে কিঞ্চিৎ হলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। দুই. উভয় পক্ষের কোনো কোনো পর্যায়ে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা অতি জরুরি। তিন. এক্ষেত্রে জেদ পরিহার করতে হবে। চার. জনগণই যে সব ক্ষমতার মালিক, অন্য কেউ নয়_ তা সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে। কিন্তু সংলাপের সূচনার আগে তার ক্ষেত্র তৈরি হতে হবে। হরতালে গাড়ি পোড়া বা সচিবালয়ে বোমা ফাটানোর কাল্পনিক অভিযোগে বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে যেভাবে জেলে বন্দী রাখা হয়েছে সে পরিবেশে সংলাপের সূচনা হবে না। যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর সরকার খড়গহস্ত তা পরিবর্তিত হতে হবে। মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন সম্ভব না হলে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি হতে পারেন এ সংলাপের কেন্দ্রবিন্দু। 'winners take all' নীতির পরিবর্তে 'win win� situation তৈরির মানসিকতা রচনা করতে হবে। আমাদের দক্ষ, প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা নিজেদের ঘরের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তা না হলে Clive অথবা Duplex-এর মতো ধুরন্ধররা আমাদের চারপাশেই রয়েছে। তখন কিন্তু নিজের ঘরেই আমরা পরবাসী হয়ে থাকতে বাধ্য হবো। যাদের আগ্রাসন ঠেকাতে পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হয়েছে, তারাও জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে পারে- এ বিষয়টিও স্মরণে রাখা প্রয়োজন।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রকৃতি ভবিষ্যতে কেমন হবে?


এমাজউদ্দীন আহমদ
দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ কোন পর্যায়ে কী করবে তা বলার সময় এখনও আসেনি বটে, তবে ভারতের সঙ্গে এসব ছোট ছোট প্রতিবেশীর যেসব সমস্যা রয়েছে তাদের সমাধানের পথ প্রশস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের সদিচ্ছা যতটুকু যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র চায় এমন এক ভারত, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধিত্বমূলক বৃহৎ শক্তি

আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রকৃতি ও স্বরূপ কেমন হবে তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত কত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে এবং চীনের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক রচনা করছে তার ওপর। গত অর্ধশতাব্দীতে ভারত তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে বাঁক পরিবর্তন করেছে বেশ কয়েকবার। বাংলাদেশের জন্মক্ষণে বিশ্ব ছিল দ্বিকেন্দ্রিক (ইরঢ়ড়ষধৎ), দুই পরাশক্তির প্রভাব বলয়ে বিভক্ত, অনেকটা ক্ষমতার ভারসাম্যের। একদিকে পরম পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিক অসামান্য শক্তির অধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন। স্নায়ুযুদ্ধের (ঈড়ষফ ডধৎ) উত্তাল তরঙ্গে তখন বিশ্ব রাজনীতি প্রবলভাবে আন্দোলিত। তারই প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া তখন ছিল দ্বিধাবিভক্ত। সত্তরের প্রথম পর্যায়ে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র-চীন অক্ষশক্তির অংশীদার ছিল পাকিস্তান আর সোভিয়েত মোর্চার অংশ ছিল ভারত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত মোর্চার অন্তরঙ্গ সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ সহজতর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সম্পর্কে হেনরি কিসিঞ্জারের কটূক্তি এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে চীনের ভেটো প্রদানের দিকে দৃষ্টি দিন, বিষয়টি আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এর আগে অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ছিল অনেকটা আদর্শিক, মধ্যপন্থার, জোটনিরপেক্ষতার। গত শতাব্দীর পঞ্চম দশকের প্রথম দিকে গান্ধী-নেহরুর ভারত পঞ্চশীলা-মন্ত্রঃপূত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে ওঠে। পণ্ডিত নেহরুর নাম উচ্চারিত হতে থাকে টিটো, জামাল নাসের, এনত্রুক্রমার সঙ্গে। এ অবস্থান থেকে সোভিয়েত কক্ষপথে প্রবেশ নেহাত কম কথা নয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে ভারতের প্রতিরক্ষা সামগ্রীর প্রধানতম উৎস। সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানির লাইসেন্স নিয়ে ভারত নিজের ভূখণ্ডেই নির্মাণ করেছে মিগসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স থেকেও লাভ করেছে যুদ্ধাস্ত্রের বিপুল সরবরাহ।
এখন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছে। এক পরাশক্তির বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র পরাক্রম সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দিন শেষ। রাশিয়া এখনও এক বৃহৎ রাষ্ট্র বটে; কিন্তু প্রভাব এবং ক্ষমতায় অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়নের ছায়ামাত্র, যদিও তার মারণাস্ত্রের ভাণ্ডার প্রায় পরাশক্তিতুল্য। এদিকে চীন দৈত্যের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে যেভাবে এগিয়ে আসছে অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তির নিরিখে, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সুষম সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, তাতে পেন্টাগনের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। একক পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বশাসনের যুক্তরাষ্ট্রের বাসনা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে সম্প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণেই চীনের পশ্চিমে অবস্থিত ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত মিত্ররূপে এরই মধ্যে বাছাই করেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের (টং ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ চবধপব) কৌশলবিদ এবং সমরবিদরা বিশ্বের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ভারতকে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেছেন।
বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে চীন এর মধ্যে তার অর্থনৈতিক পেশি ভয়ঙ্করভাবে সুদৃঢ় করেছে। আগামী দশকে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তার অর্থনৈতিক পেশি সুদৃঢ় হলে সামরিক শক্তির ভাণ্ডার অফুরন্ত হয়ে উঠবে। রাশিয়াও চীনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে। চীন যেন সমরাস্ত্র তৈরিতে পিছিয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে যেমন লাইসেন্সিংয়ের ব্যবস্থা করছে রাশিয়া, তেমনি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে (ফোর্থ জেনারেশন) বিনির্মাণের প্রযুক্তিও হস্তান্তর করছে চীনের কাছে। রাশিয়ার সহযোগিতায় চীন তার গণমুক্তিফৌজের অবকাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করে তাকে আরও গতিশীল করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে প্রেসিসন গাইডেড অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগের কলাকৌশল উদ্ভাবনেও। এক কথায়, চীন হতে চলেছে আরেক পরাশক্তি, যা অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং অনেক বেশি শক্তি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা প্রতিরক্ষা বিশারদ রিচার্ড ফিশারের সংক্ষিপ্ত বিবরণের প্রতি শব্দে, এসব কারণে, যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার প্রকাশ ঘটেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার।
বছর চারেক আগে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখার্জি সফরকালে তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ১০ বছরমেয়াদি প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত চুক্তি সই করে এসেছেন তাতেও ভীষণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি হয়েছে মিশাইল প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পারমাণবিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ ও উৎপাদন কৌশল উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মূল্যায়নের গতি দ্রুতকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র একযোগে কাজ করে যাবে। এরই সপ্তাহখানেক পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় কক্ষে প্রদত্ত ভাষণে এবং বুশ-মনমোহন যৌথ ঘোষণায় যা প্রকাশিত হয়েছে তারও মূলকথা হলো দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভারতে পরমাণু প্রযুক্তি হস্তান্তরের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে অনতিবিলম্বে। ফলে বেসামরিক পরমাণু প্রযুক্তি সংগ্রহে ভারতের আর কোনো বাধা থাকবে না। ভারত স্বীকৃতি লাভ করবে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিরূপে এবং শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পুরো এশিয়াই স্বীকৃতি লাভ করতে পারে অন্যতম বৃহৎ শক্তিরূপে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই টানাপড়েনে কে, কোথায়, কীভাবে, কোন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট হবে তা ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করুক, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিবেশী, বিশেষ করে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হতে পারে ভাবুন তো! দীর্ঘদিনের ভারতের ইচ্ছা_ অর্থনৈতিক, সামরিক, পারমাণবিক ক্ষেত্রে চীনের পাল্টা বৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করা তথা এশিয়ায় নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠার বাসনা_ এ চুক্তির ফলে পূর্ণ হতে চলেছে বলে ভারতের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আগামী দশকেই ভারতের স্থান হতে চলেছে চতুর্থ। নীল পানির নৌবাহিনীর অবস্থান আগামী দশকে উঠে আসবে চতুর্থ কি পঞ্চমে। সামরিক বাহিনীর অবস্থান এখনই চতুর্থ। ক'দিন পরই ভারত হতে যাচ্ছে এলিট পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এ অবস্থান সত্যি সত্যিই ঈর্ষণীয়। নয় কি?
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক সময় দক্ষিণ এশিয়া ছিল শুধু পাকিস্তান। উঠতি সোভিয়েত সাম্রাজ্যের গতিরোধক হিসেবে খাইবারপাসের পরই ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তিও সম্পাদন করেছিল সেই ১৯৫৪ সালে। তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে। বহু চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে পাকিস্তান আজও চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পিছু পিছু। ভারতের বহু নীতিনির্ধারক সেদিন পর্যন্ত এসব কারণে পাকিস্তানকে 'সাম্রাজ্যবাদের ভৃত্য' বলে গালাগাল করেছেন এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে ঘৃণা করে এসেছেন। ভারত জেনেশুনেই সেই অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করছে। পাকিস্তান কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকতেই ভালোবেসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের যোদ্ধাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল নিজেদের ঘরের দরজা পর্যন্ত। ফলে জর্জ বুশ, এমনকি কন্ডোলিৎসা রাইস পর্যন্ত ভূয়সী প্রশংসা করেছেন পাকিস্তানের। পাকিস্তানকে চিহ্নিত করেছেন ন্যাটোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্ররূপে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এ সাম্প্রতিক চুক্তির পর পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র ভুলে যাবে কি? ভারত অবশ্য তাই চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ভাষণদানকালে ড. মনমোহন সিং পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বব্যাপী পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পরিবর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান অরক্ষিত পরমাণু অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিস্তার করে চলেছে। পরমাণু ও সন্ত্রাস বিস্তার প্রশ্নে পাকিস্তানকে 'দায়িত্বহীন' বলে আখ্যায়িত করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচুর হাততালির মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়। কিন্তু চীনকে কনটেইন (ঈড়হঃধরহ) করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই জানে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমের পাকিস্তানকে উপেক্ষা করা বা পাকিস্তান সম্পর্কে উদাসীন থাকা প্রায় অসম্ভব এবং তাও দুটি কারণে_ এক. শক্তি, প্রভাব এবং চীনবিরোধী মনোভাবের নিরিখে পাকিস্তান ভারতের সমকক্ষ না হলেও যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ভুলে যেতে পারে না, বিশেষ করে তার কৌশলগত অবস্থানের জন্য। দুই. দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তির একটি হলো পাকিস্তান। তাই কনভেনশনাল আর্মামেন্টে অনেক দুর্বল হয়েও পাকিস্তান চূড়ান্ত পর্যায়ে সক্ষম হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় না হলেও ভীতির ভারসাম্য (ইধষধহপব ড়ভ ঞবৎৎড়ৎ) প্রতিষ্ঠায়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু চীন সীমান্তে দণ্ডায়মান পাকিস্তান ঋণ স্বীকার করে চীনের। এ কারণেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে উপেক্ষা করে কী করে?
দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যেমন পাকিস্তানের অবস্থান, দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে তেমনি অবস্থান বাংলাদেশের। চীনের মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে নেপাল এবং ভুটানও। শ্রীলংকার দিকে তাকান, দেখবেন তার অবস্থানও কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ শতাব্দীতে বৃহৎশক্তি বা পরাশক্তিগুলোর শক্তি পরীক্ষার প্রধান কেন্দ্র স্থলভাগ বা ভূখণ্ড হবে না, হবে সমুদ্র এবং ভারত মহাসাগরের অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরের উপকণ্ঠে বঙ্গোপসাগরের তীরেই বাংলাদেশ আর অদূরেই দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা। যুক্তরাষ্ট্র চায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় তার নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করতে। চায় দিয়াগো গার্সিয়া থেকে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ অবাধ রাখতে। ভারতকে ভালোভাবে জেনেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত কতটুকু জেনেছে সে সম্পর্কে বিভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবে লম্বা লম্বা পা ফেলে আসা চীনের গতি রুদ্ধ করতে উভয়ের মনের মিল (গববঃরহম ড়ভ গরহফং) ঘটেছে। লক্ষ্য এক ও অভিন্ন হলেও পদ্ধতি সম্পর্কে ভিন্ন ভাবনা আজ না হোক আগামীকাল নিশ্চয়ই দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বিশ্বময় তার একক পরাশক্তিসুলভ প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখতে, কিন্তু ভারতের লক্ষ্য, পুরো এশিয়ায় তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই ভারতের জন্য যথেষ্ট নয়। দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত তা বিস্তৃত হোক_ এটি ভারতের লক্ষ্য। তাই চীনকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে, চীনের সার্থকভাবে মোকাবেলার জন্য, ভারত চায় দক্ষিণ এশিয়ার পুরো পূর্বাঞ্চলকে ভারতের বর্ধিত সীমানা (ঊীঃবহফবফ ঋৎড়হঃরবৎ) রূপে ব্যবহার করতে। এ লক্ষ্যে যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে অস্থিতিশীল হতে হয় তা হোক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা-ভাবনায় চীনকে মোকাবেলার সঠিক পন্থা হলো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট-বড় সব রাষ্ট্রকে সম্মিলিত করে চীনের মুখোমুখি করা এবং এ জন্য প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে চীনের আদর্শিক অঙ্গীকারের সব আবেদনকে মুছে ফেলা। এ ভিন্নতাই কালক্রমে চুক্তির দু'পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
অন্যদিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এ যৌথ উদ্যোগের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় চীন-রাশিয়াও উদ্যোগী হয়েছে ভারতের তিন পাশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এবং প্রয়োজনবোধে দক্ষিণ এশিয়াকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলার। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এ চুক্তি পুরো এশিয়া নতুনভাবে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের যে সৃষ্টি করতে যাচ্ছে তা প্রায় নিশ্চিত। এ স্নায়ুযুদ্ধের ফল হবে মিশ্র। এক. দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়া, এমনকি মধ্য এশিয়া পর্যন্ত তাই বিস্তৃত হতে যাচ্ছে। উজবেকিস্তান ও কিরঘিজস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসছে ২০১৪ সালে। মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত এর প্রভাব হয়ে উঠবে শক্তিশালী। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে চলে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ কোন পর্যায়ে কী করবে তা বলার সময় এখনও আসেনি বটে, তবে ভারতের সঙ্গে এসব ছোট ছোট প্রতিবেশীর যেসব সমস্যা রয়েছে তাদের সমাধানের পথ প্রশস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের সদিচ্ছা যতটুকু যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাবে, কেননা যুক্তরাষ্ট্র চায় এমন এক ভারত, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধিত্বমূলক বৃহৎ শক্তি। তেমন হতে হলে ভারত এতদিন যেভাবে ছোট প্রতিবেশীদের প্রতি উদাসীন থেকেছে, তা থেকে বহু যোজন সরে এসে ভারত বাধ্য হবে উদার হতে, নতুনভাবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের বিন্যাস পাল্টাতে, অনেকটা মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর অথবা ফ্রান্স-বেলজিয়াম বা জার্মানি-লুক্সেমবার্গ বা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার সম্পর্কের আদলে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি যত হবে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু তাত্তি্বকের রচিত এবং ভারতের বেশকিছু পর্যালোচকের প্রচারিত 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' বা 'অকার্যকর রাষ্ট্রের' ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অকাল মৃত্যু ঘটবে। তবে এ ঝড়ের মধ্যে প্রত্যেকটি রাষ্ট্র বাধ্য হবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে। ফলে উদ্বেগের এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে দক্ষিণ এশিয়ার চারপাশ ঘিরে।

অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়